প্রাচীন বাংলা কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল এবং প্রাচীন বাংলার শাসনামল -এ বেশ কিছু প্রাচীন নগরের বৈদিক যুগে পত্তন এখানে হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত বিভিন্ন দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চল মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্য সহ আরও অনেক ভারতীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। প্রাচীন বাংলার শাসনামল বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিক শাসকদের রাজধানী রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে।
১. মৌর্য শাসনঃ খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতে অখণ্ড ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সাম্রাজ্য গঠনে মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল প্রথম সফল পদক্ষেপ। মধ্যভারতের ক্ষুদ্র রাজ্য পিপলীবনের মোরিয় নামের ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণকারী চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। আলেকজান্ডারের-প্রত্যাবর্তনের পর চন্দগুপ্ত মৌর্য ভারতবর্ষে বৃহদাংশ সম্বলিত এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় সম্রাট। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে সম্রাট অশোকের আমলে পুন্ড্রবর্ধনে তার শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তরবঙ্গে মৌর্য শাসনের প্রমাণ বহন করে বগুড়া জেলার মহাস্থানে প্রাপ্ত শিলাখণ্ড লিপি। মৌর্যবংশের দশম রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে সেনাপতি পুষ্যমিত্র মৌর্য শাসনের অবসান ঘটান।
২. গুপ্ত শাসনঃ খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের শুরুতে গুপ্ত বংশের উত্থান ঘটে। এ গুপ্ত রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীগুপ্তের পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। গুপ্তরাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলেই উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ গুপ্ত শাসনাধীনে আসে। পাটলিপুত্র ছিল এর রাজধানী। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত পাটালিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। তিনি গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। বাংলার অনেকাংশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেন বলে তাকে প্রাচীন ভারতের নেপোলিয়ান বলা হয়। সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এর রাজত্বকালে চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন ভারতে আসেন। গুপ্ত বংশের শেষ শাসক ছিলেন বুধগুপ্ত।
৩. শশাংকর যুগঃ বাঙালি রাজাদের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সার্বভৌম নরপতি। উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্ত বংশীয় রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের কিছু পূর্বে শশাঙ্ক পরবর্তী গুপ্ত শাসকদের হাত থেকে গৌড় মুক্ত করে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ। সম্ভবত ৬৩৭ খ্রিষ্টাদ্বের কিছু আগে তার মৃত্যু হয়। শশাঙ্কই সর্বপ্রথম বাংলা থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত এক সার্বভৌম রাজ্য গড়ে তোলেন।
৪. মাৎস্যন্যায়ঃ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর প্রায় ১০০ বছর বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা অতিশয় শোচনীয় হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলার সুযোগে এবং উপর্যুপরি বিদেশী শত্র“র আক্রমণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বহুলাংশে ধবংশপ্রাপ্ত হয় এবং এক অস্থির অবস্থার সৃষ্টি করে। এ সময় কোনো স্থায়ী শাসন গড়ে উঠার সুযোগ পায়নি এবং শক্তিশালী ভূ-স্বামীরা আধিপত্য বিস্তারের জন্য পরস্পর সংঘাতে মেতে ওঠে। অভ্যন্তরীণ গোলযোগে, তদুপরি বিদেশী আক্রমণ এই সময়ে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলাকে আরো বাড়িয়েছে। এই অরাজকতাই মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যায়িত হয়েছে।
৫. পালশাসনঃ ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে পরবর্তী শতাব্দীকাল বাংলায় অরাজকতা চলতে থাকে। অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়ে গোপালের সিংহাসনে আরোহণের মধ্যেদিয়ে পাল শাসন শুরু হয়। গোপালের মৃত্যুর পর তার পুত্র ধর্মপাল রাজা হন। তিনি বৃহত্তর রাজশাহী জেলার (বর্তমান নওগাঁ) পাহাড়পুরে একটি বিহার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। বিহারটির নাম ছিল সোমপুর বিহার। এটি সে সময়ে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। ধর্মপালের অপর নাম বিক্রমশীল। ধর্মপালের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন পুত্র দেবপাল। দেবপালের মৃত্যুর পর থেকে পাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। গোবিন্দপালই ছিলেন শেষ পাল সম্রাট। অষ্টম শতকের মধ্যভাগে গোপাল গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করে পালবংশের সূচনা করেন এবং দ্বাদশ শতকের ষষ্ঠ দশকের শুরুতে চার শতাব্দীব্যাপী স্থায়ী পাল সাম্রাজ্যের শেষ চিহৃ বিলুপ্ত হয়ে যায়।
৬. সেন শাসনঃ একাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে সেন বংশ নামে এক নতুন রাজবংশের শাসন শুরু। সামস্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন পাল বংশের দুর্বল রাজত্বকালে রাঢ়ে এক স্বাধীন রাজ বংশের ভিত্তি রচনা করতে সক্ষম হন।
ক) বিজয় সেঃন বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের প্রথম স্বাধীন রাজা। রাজপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। সে সুযোগে বিজয় সেন নিজ শক্তি বৃদ্ধি করতে প্রয়াস পান। বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। হুগলী জেলার ত্রিবেনীতে অবস্থিত বিজয়পুর ছিল বিজয় সেনের প্রথম রাজধানী। তিনি দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন বাংলাদেশে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে।
খ) বল্লাল সেনঃ পিতার মৃত্যুর পর সেন শাসনের দায়িত্ব অর্পিত হয় পুত্র বলাল সেনের ওপর। অন্যান্য উপাধির পাশাপাশি বল্লাল সেন নিজ নামের সাথে যুক্তকরেন অরিরাজ নিঃশঙ্ক শঙ্কর উপাধি। তিনি‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভূতসাগর’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন।
গ) লক্ষ্মণ সেনঃ বল্লাল সেনের পর পুত্র লক্ষ্মণ সেন সিংহাসনে আরোহণ করেন।
১২০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী নামে এক তুর্কী ভাগ্যাম্বেষী এই অঞ্চল আক্রমণ করে সেন সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেন। বখতিয়ার খলজী নদীয়া আক্রমণ করলে লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরে অবস্থান নেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরে লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর মাধ্যমে সেন বংশের পতন ঘটে। সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্ম বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। হিন্দুদের কুলীন প্রথা এ সময়ে দৃঢ়রূপ লাভ করে। লক্ষ্মণ সেনের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলায় সেন শাসনের অবসান ঘটে এবং সেই সাথে সমাপ্তি ঘটে প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের।