৪১তম বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী
ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড চীনের একটি মহাপরিকল্পনা। এটি প্রায় দুই হাজার বছর আগের সিল্ক রোডের আধুনিক সংস্করণ মাত্র। প্রাচীন সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীন এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের সাথে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো। প্রাচীন সেই সিল্ক রোডকে আবার সক্রিয় করতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং ২০১৩ সালে রোড অ্যান্ড বেল্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনার আওতায় চীন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ ও ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোড’ এর মাধ্যমে প্রায় ৬০টি দেশের সাথে সরাসরি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা বিনিময়ের মাধ্যমে এসব দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে কাজ করে যাবে। ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ এর আওতায় চীনের সিয়ান থেকে উরুমুকি হয়ে তুরস্ক, কাজাখস্তান, মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের রটারডাম হয়ে স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ নির্মিত হবে। টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোডের মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও সিঙ্গাপুরের সাথে আফ্রিকার জিবুতি ও কেনিয়ার সমুদ্র বন্দরের সাথে চীনের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই সামুদ্রিক রোডের আওতায় দুটি ইকোনমিক করিডোর চালু হবে যার একটি চীনের জিনজিয়াং থেকে পাকিস্তানের গাওদার সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত এবং অন্যটি চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার হয়ে কলকাতা (কে টু কে ) পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ নির্মিত হবে।
বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্তি
নানা বাধা-বিপত্তির মুখে বাংলাদেশ ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের সময় বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান গ্লোবালাইজেশনের যুগে দেশের অর্থনীতি বন্দি করে রাখলে খুব বেশিদূর আগানো যাবে না অর্থনীতিকে যতটা সম্ভব মুক্ত করে দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের লিস্টে প্রবেশের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সে লক্ষ্য অর্জনে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যবসায়িকসহ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের সেই চেষ্টাকে আরো একধাপ সামনে প্রসারিত করবে। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় কে টু কে সড়ক ও রেলপথ নির্মিত হলে স্থলপথে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। চীন বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশ। চীন নিজেদের প্রয়োজনেই বাড়তি অর্থ অন্য দেশে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগের অভাবে চীনা ব্যবসায়ীরা এদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। কে টু কে রোড নির্মিত হলে আমাদের দেশে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়বে, দেশে নতুন নতুন শিল্পকারখানা তৈরি হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলবে। চীন থেকে আমরা প্রতিবছর বিপুল পরিমান পণ্য আমদানি করে থাকি কিন্তু এসব পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত খরচের জন্য দাম বেড়ে যায়। কুনমিং থেকে স্থলপথে পণ্য পরিবহনে যেমন খরচ কম হবে অন্যদিকে সময়ও কম লাগবে ফলে দেশের বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের জন্য ক্রেতাদের অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হবে না। এই ইকোনমিক করিডোরের আওতায় সুদূর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ থেকেও সড়কপথে পণ্য আমদানি করাও সম্ভব হবে। বিশেষ করে কক্সবাজারে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপিত হলে এবং চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সুদূর মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করাও সম্ভব হবে।
চীন বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। ধারণা করা হয়, ২০৫০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সেরা অর্থনৈতিক শক্তির দেশ হবে চীন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি শক্তিশালী চীনের সঙ্গে। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চীন তার উদ্বৃত্ত অর্থনীতি এ প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রায় ৬০ দেশে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত। ইতোমধ্যে চীন যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। তাই এ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়ে চীনের সুবিশাল অর্থনীতি থেকে প্রয়োজনীয় সুবিধা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রের যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগুচ্ছে সেখানে পৌঁছুতেও আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে চীনের এই উদ্যোগ সফল হওয়া দরকার। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শ্রম আদান-প্রদান, প্রযুক্তির উন্নয়ন, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মানব সম্পদের উন্নয়ন ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথটি আরো মসৃণ হয়ে যাবে।
মাহমুদুর রহমান মানিক
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।