বাংলার রাজবংশ ও তাদের শাসনামল
১. খরগ শাসন ঃ সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যখন মগধ ও গোড়ে পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাগণ প্রভুত্ব স্থাপন করেন, সে সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় খড়গ বংশের উদ্ভব হয়। খড়গদের রাজধানীর নাম ছিল কর্মান্তবাসক। বর্তমান কুমিলা জেলার বড়কামতাই সম্ভবত কর্মান্তবাসক। নোয়াখালী ও ত্রিপুরা অঞ্চলের ওপরও খড়গদের অধিকার বিস্তৃত হয়।
২. দেব শাসন ঃ খরগ বংশের শাসনের পর অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভাগে এ অঞ্চলে দেব রাজবংশের উদ্ভব হয়। দেব বংশের রাজারা পরমভট্টারক, পরমসৌগত, পরমেশ্বর ও মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। দেব রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তাদের রাজধানী ছিল দেব-পর্বতে (কুমিলার নিকট ময়নামতির কাছে)। দেবরাজা আনন্দদেব ময়নামতিতে আনন্দবিহার নামে একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেছিলেন। এ বিহার বৌদ্ধ শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল।
৩. চন্দ্র শাসন ঃ প্রবল পরাক্রান্ত চন্দ্রবংশ পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে রাজত্ব করতো। এ বংশের প্রথম দুজন রাজা পূর্নচন্দ্র ও তার পুত্র সুবর্ণ চন্দ্র রোহিতগিরিতে রাজত্ব করতেন। পরবর্তীকালে এ বংশীয় রাজাদের রাজধানী ছিল কুমিলার নিকটবর্তী ক্ষীরোদা নদীর তীরে দেবপর্বত নামক স্থানে।
৪. বর্ম শাসন ঃ বর্ম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বজ্রবর্মার পুত্র জাতবর্মা। বর্মদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। জাতবর্মার পর তার পুত্র হরিবর্মা রাজা হন। তিনি একটানা ৪৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। পাল রাজাদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝপূর্বে সেন বংশীয় রাজা বিজয় সেন বর্ম শাসনের অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সেন বংশের সূচনা করেন।
মধ্যযুগে বিভিন্ন শাসনামলে বাংলা
১. তুর্কী আমল ঃ বখতিয়ার খলজী বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। বাংলায় মুসলিম শাসন পর্বের প্রথম পর্যায় ছিল ১২০৪ খ্রি. থেকে ১৩৩৮ খ্রি. পর্যন্ত। এ যুগের শাসকদের মধ্যে কেউ ছিলেন কখতিয়ারের সহযোদ্ধা খলজী মালিক, আবার কেউ ছিলেন তুর্কী বংশের শাসক। কখতিয়ার খলজীর মৃত্যুর পর তার তিনজন সহচর একের পর এক বাংলায় ক্ষমতা দখল করেন। ইওয়াজ খলজীর সময় দিলীর শাসনকর্তা ছিলেন ইলতুৎমিশ। এ সময়ের ১৫ জন শাসকের মধ্যে ১০ জন দাস ছিলেন বলে অনেকে এ সময়ের বাংলার শাসনকে দাস শাসন বা মামলুক শাসন নামে অভিহিত করেন। কিন্তু এ যুগের ১৫ জন শাসকের সকলেই তুর্কী বংশের ছিলেন। বাংলার প্রথম তুর্কী শাসনকর্তা ছিলেন ইলতুৎমিশের পুত্র নাসির উদ্দিন মাহমুদ। ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে নাসির উদ্দিন মাহমুদের মৃত্য হয়।
২. সুলতানী আমল ঃ ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রি. পর্যন্ত ২০০ বছর দিলীর সুলতানগণ বাংলাকে তাদের অধিকারে রাখতে পারেননি বললেই চলে। তাছাড়া এ সময়ে বহিঃশত্র“র তেমন আক্রমণের সম্ভবনা না থাকায় বাংলার সুলতানগণ নিশ্চিন্তে ও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে পেরেছেন। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের মাধ্যমে সোনারগাঁওয়ে স্বাধীনতার সূচনা হলেও ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতানদের হাতে বাংলা (সমগ্র) প্রথম স্থিতিশীলতা লাভ করে। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁয়ে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, সে সময়ে লখনৌতে ও সাতগাঁওয়ের শাসনকেন্দ্রে দিলীর সনোনীত শাসকগণ রাজত্ব করতেন। পরবর্তী পর্যায়ে তার পুত্র ইখতিয়ার উদ্দীন গাজী শাহের রাজত্বকালে ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁওদখল করেন। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ১৩৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে আসেন। ইবনে বতুতা আফ্রিকা ও মধ্য-এশিয়ার মুসলিম দেশসমূহ সফর শেষে দিলীতে এবং তারপর বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে তার আগমনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সিলেটে হযরত শাহজালাল (র) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
ক) ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ্ ঃ মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ সালে ভারতবর্ষে আগমন করেন। তিনি ১৩৪৫ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সময়ে বাংলা সফর করেন। বাংলায় খাদ্যসামগ্রীর প্রাচুর্য এবং প্রতিকুল আবহাওয়ার জন্য বাংলাকে তিনি ‘ধনসম্পদপূর্ণ নরক’ বা ‘দোযখপুর নিয়ামত’ বলে আখ্যায়িত করেন।
খ) শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্ ঃ শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সালে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি এ ভূখন্ডের নামকরণ করেন ‘মূলক-ই-বাঙ্গালাহ’ এবং নিজেকে ‘শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলার স্বাধীনতা সূচনা করলেও প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন শাসমুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।
গ) গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ্ ঃ সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের রাজত্বকালে প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য রচনা করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের সাথে পত্র বিনিময় করতেন। তাঁর আমলে বিখ্যাত মুসলিম সাধক শেখ নূরুদ্দীন কুতব-উল আলম ইসলাম প্রচার করেন। এ সময়ে মা হুয়ান নামক চীনা পর্যটক বাংলা সফর করেন। বর্তমানে সোনারগাঁয়ে গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের মাজার রয়েছে।
ঘ) নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ্ ঃ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের সময় প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক খানজাহান আলী খুলনা ও যশোর অঞ্চল দখল করে বাগেরহাটে ষাট গম্বুজ মসজিদ (মোট গম্বুজ ৮১টি) নির্মাণ করেন। তাঁর সময়ের পাঁচ খিলান বিশিষ্ট পাথরের পুল, কোতায়ালী দরওয়াজা এবং দুর্গের প্রাচীর এখনও চিকে আছে।
ঙ) আলাউদ্দীন হুসেন শাহ ঃ সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ হলেন বাংলার সুলতানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাঁর সময়ে সেনাপতি পরগল খানের উৎসাহে কবীন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের একাংশ বাংলায় অনুবাদ করেন। পরাগল খানের পুত্র ছটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের একাংশ বাংলায় অনুবাদ করেন। সুলতান হুসেন শাহের সময়ে কবি মালাধর বসু ও বিজয় গুপ্ত তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেন। মালাধর বসুকে সুলতান গুণরাজ খান উপধি দান করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের হিন্দু প্রজাগণ তাঁকে ‘পূপতি তিলক’ ও ‘জগৎ ভূষণ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁকে বাদশাহ আকবরের সাথে তুলনা করা হয়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারক শ্রী চৈতন্যদের তাঁর নিকট খুব সম্মান লাভ করেন। তিনি গৌড়ের ‘ছোট সোনা মসজিদ’ নির্মাণ করেন।
চ) নুসরত শাহ ঃ আলাউদ্দিন হুসেন শাহের পুত্র নুসরত শাহ গৌড়ের ‘বড় সোনা মসজিদ’ এবং ‘কদম রসুল মসজিদ’ নির্মাণ করেন। তাঁর সময়ে কবি শ্রীধর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। ১৫৩৮ সালে শের খান গৌড়, দখল করলে বাংলার দু’শ বছরের স্বাধীন সুলতানী শাসনের অবসান ঘটে।
ছ) আফগান আমল ঃ ১৫৩৮ সালের এপ্রিলে শের খান গৌড়জয় করলে বাংলার স্বাধীনতা লোপ পায় এবং বাংলাদেশ আফগানদের অধিকারে চলে যায়। ১৫৩৮ থেকে ১৫৭৬ সালে আকবরের বাংলা জয় পর্যন্ত আটত্রিশ বছর বাংলার ইতিহাস মূলত আফগান শাসনের ইতিহাস। এ সময়ে প্রথমে শের খান ও তর বংশের রাজত্বকালে বাংলাদেশ দিলি সাম্রাজ্যের অধীনস্থ একটা অঞ্চল হিসেবে শাসিত হয়। দাউদ কররানী অদূরদর্শী ও উদ্ধত শাসক ছিলেন। দাউদ খান কররানীর ঔদ্ধত্য মুঘলদের সাথে সংঘর্ষের মূল কারণ। ফলে দাউদ খান কররানীর শাসনকালে মুঘলদের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহেই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। অনেক খণ্ড খণ্ড সংঘর্ষের পর ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানীর চূড়ান্ত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় কররানী তথা আফগান শাসনের যবনিকাপাত ঘটে এবং মুঘল শাসনের সূত্রপাত হয়।
জ) শের শাহ ঃ শের খান দিলীর সিংহাসন দখল করে ‘শের শাহ’ উপাধি ধারণ করেন। শের শাহ বাংলায় ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করেন। তিনি সোনারগাঁও হতে পাকিস্তানের পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত বিখ্যাত ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’ নির্মান করেন। ১৫৪৫ সালে বারুদ বিস্ফোরণে শের শাহ নিহত হন। শের শাহ বাংলায় যে আফগান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করেন তা ইতিহাসে ‘শুর বংশ’ নামে পরিচিত। ১৫৬৪ সালে তাজ খান কররানী শূর বংশের হাত হতে বাংলা দখল করে কররানী বংশের শাসনের সূচনা করেন।