বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোন চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই।আজ যে দেশ আমাদের বন্ধু কাল সে শত্রু। আবার আজকের শত্রু হতে পারে কালকের বন্ধু।তাই স্বাধীনতা যুদ্ধে সৌদি আরব অখন্ড পাকিস্তানকে সমর্থন দিলেও আজ সময়ের প্রয়োজনে এটি আমাদের মিত্র রাষ্ট্র।
বাংলাদেশ–সৌদি আরব সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে যখন সৌদি আরব ১৯৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বর্তমানে এই দুই দেশের সম্পর্ক ভাতৃপ্রতীম, সুদৃঢ় এবং ক্রমবিকাশমান।
বাণিজ্যিক সম্পর্কঃ
★১৯৭৬ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে ২১৭ জন শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরবে জনশক্তি রফতানি শুরু হয়। এসব শ্রমিকের সঙ্গে ৬৪ টন কাদামাটি এবং ৫০ কেজি নিমের বীজও পাঠানো হয়েছিল। এসব শ্রমিক পাঠানোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের যাত্রা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
★বাংলাদেশ সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত ৪০ বছরে ২৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৯৮ জন বাংলাদেশী কর্মী সৌদি আরব গেছেন। তবে গবেষকদের মতে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি আরবের বিভিন্ন খাতে কর্মরত রয়েছেন।
★২০১৫ তে সৌদি আরব ৬ বছর পর বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানির
(গৃহকর্মী ব্যতীত সব শ্রমিক নিষেধ ছিল) উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়
★গবেষকদের মতে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ২৫ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক সৌদি আরবের বিভিন্ন খাতে কর্মরত রয়েছেন। সৌদি আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাসহ বিভিন্ন উচ্চপদে বাংলাদেশীরা সম্মানের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে ৬০ হাজারেরও বেশি নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে পৌঁছেছে। এ হিসাবে সৌদি আরবই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার।
★ প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশী ভিজিট ভিসায় সৌদি আরব চলে গেছেন এবং আরও লক্ষাধিক যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
★বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সৌদি আরবের সরকারি ও বেসরকারি অবদান অন্য যে কোনো দাতা দেশের তুলনায় কম নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সৌদি আরবের অবদান অনেকাংশে বেশি।
★স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এবং বিভিন্ন সময়ে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সৌদি আরবের আর্থিক সহযোগিতার কথা অনস্বীকার্য।
★সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কে মূলভিত্তি ধর্মীয় হলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৫ বছরে দুই দেশের সম্পর্কে আরও কিছু শক্তিশালী উপাদান যুক্ত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, জনশক্তি রফতানি বা সৌদি শ্রমবাজারে বাংলাদেশীদের প্রবেশ এবং উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা।
★বাংলাদেশের অবকাঠামোগত ও শিক্ষাগত উন্নয়নে সৌদি আরবের অবদান দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য, সাবেক সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ বাংলাদেশের সিডর আক্রান্ত উপকূলীয় এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের জন্য ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে গোপনে দান করেছিলেন।
আর এ দানের কথা তার মৃত্যুর আগে কেউ জানত না। তিনি আইডিবি প্রেসিডেন্ট আহমাদ মুহাম্মাদ আলীকে অনুরোধ করেছিলেন যে, তার মৃত্যুর আগে যেন দাতা হিসেবে তার নাম প্রকাশ করা না হয়। সেই শর্ত মোতাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহ ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করার পর তিনি তা প্রকাশ করেন এবং সমগ্র বিশ্ব জানতে পারে যে, তিনি কত বড় দাতা ছিলেন
★বাদশাহ আবদুল্লাহর দেয়া সেই অর্থের মধ্যে ১১০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ১৭৩টি স্কুল কাম সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। যার মধ্য থেকে নির্মাণ শেষ হওয়া কিছু সেল্টার ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে কিং আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ আলে সাউদ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাকটিভিটিজের (কেএআইএফএইচএ) প্রধান নির্বাহী ও বাদশাহ আবদুল্লাহর ছেলে প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহ উদ্বোধন করে যান। বাকি ২০ মিলিয়ন ডলার ওয়াকফ করা হয়েছে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নে সৌদি আরবের অবদান এখন আর কারও অজানা নয়।
★ সৌদি আরবের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স, পিএইচডি কোর্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন অসংখ্য বাংলাদেশী।
★এছাড়াও সৌদি আরব প্রতি বছর প্রচুর কোরআন, ইসলামী বই-পুস্তক, খেজুর, কোরবানির পশুসহ বিভিন্ন আইটেমের উপহারসামগ্রী বাংলাদেশে পাঠায়
★সৌদি আরবে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ লোক পবিত্র হজ্ব পালনের জন্য গমন করে। এছাড়া সৌদি আরব বাংলাদেশের নির্দিষ্ট সংখ্যক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সৌদি বাদশাহর বিশেষ মেহমান হিসেবে হজ করার সুযোগ প্রদান করে থাকে।
★সর্বশেষ এইবছর মার্চ মাসে সৌদি আরব বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পরিষদের ১২ তম বৈঠকে দুইদেশের
মধ্যে কৃষি,শিল্প,শিক্ষা,রেমিট্যান্স,আমদানি রপ্তানি বানিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ববহ আলোচনা হয়।
কূটনৈতিক সম্পর্কঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই সৌদি আরব স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখ- হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে তৎকালীন সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ এবং বাংলাদেশের ওআইসির সদস্য হওয়ার মাধ্যমে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব কমতে থাকে। পরবর্তী বছর ১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট জাতির পিতার নৃশংস শাহাদাত বরণের পর সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক চলমান রয়েছে।
সামরিক সম্পর্কঃ
★সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আলে সাউদের উদ্যোগে এবং সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশসহ ৩৪টি মুসলিম দেশের সমন্বয়ে ইতিহাসে সর্বপ্রথম ইসলামী সামরিক জোট গঠন করা হয়।
★বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে গত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে যৌথ সামরিক মহড়া যার আয়োজক সৌদি আরব। এ মহড়ার নাম ‘গালফ শিল্ড-১’। এক মাসব্যাপী এই সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৮ সদস্য। সৌদি আরবের সঙ্গে এটাই প্রথম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যৌথ সামরিক মহড়া। এতে বাংলাদেশ ও আয়োজক সৌদি আরব ছাড়াও ১৯টি অন্য দেশ অংশ নিয়েছে।
★এর উদ্দেশ্য অধিকতর সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। সমাপনী অনুষ্ঠানে দিতে রোববার ১৫ এপ্রিল সৌদি আরবে পৌঁছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সৌদি আরবের বাদশা সালমান।
★এই মহড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হতে পারে। অবশ্যই বাংলাদেশের দিক থেকে এটি একটি অত্যন্ত বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত।
★ ১৯৯০ এর শুরুতে প্রথমবার উপসাগরীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
★ সৌদি আরবের সঙ্গে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
উপসংহারঃ
আশা করছি, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব বাংলাদেশ সুসম্পর্ক মুসলিম বিশ্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে। সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, মিয়ানমারসহ বিশ্বের যেখানেই মুসলিমরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। সৌদি আরবের প্রতি সারা বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের আশা-আকাঙক্ষার মাত্রাও বেশি। আগামী বছরগুলোয় সৌদি আরব বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম দেশের সাথে সুসম্পর্কের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব পালনে আরও সচেষ্ট হবে বলে আশা করছি।
NILOY SEN GUPTA