দেশবাচক নাম হিসেবে ‘বাংলা’র ব্যবহার মুসলিম অধিকারের যুগে প্রচলিত হয়। সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৫২-১৩৫৮) লক্ষণাবতী, রাঢ়, বাঙ্গালা প্রভৃতি অঞ্চলের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করে নিজে শাহ-ই-বাঙ্গালা ও সুলতান-ই-বাঙ্গালা উপাধি ধারণ করেন। এ সময় থেকেই সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী ভূ-ভাগ বাঙ্গালা নামে পরিচিত হয় এবং অধিবাসীরা বাঙ্গালি নামে অভিহিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগেকার ঋগে¦দের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ নামে দেশের প্রথম উলেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাস-বিষয়ক আলোচনায় যুগের বিভাজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে । ঐতিহাসিকগণ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় তেরো শতক পর্যন্ত সময়কালকে বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন যুগ বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় ছয় শতক পর্যন্ত সময়কালকে আদি ঐতিহাসিক যুগ এবং খ্রিষ্টীয় সাত শতক থেকে তেরো শতক পর্যন্ত সময়কালকে প্রাক-মধ্যযুগ বলেও যুগ বিভাজন করে থাকেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বাংলা প্রদেশ পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলা নামে দুটি প্রদেশে বিভক্ত হয়। পূর্ববাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের এবং পশ্চিমবাংলা ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ নাম গ্রহণ করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
বাংলার জনপদ সমূহ :
প্রাচীনকালে বাংলাদেশে কোনো একক রাষ্ট্র ছিল না। এটি তখন কতকগুলো অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। অঞ্চলগুলো জনপদ নামে পরিচিত ছিল। প্রায় ১৬টি জনপদের কথা জানা যায়। ভিন্ন ভিন্ন রাজা এক একটি জনপদ শাসন করতেন।
বাংলার জনপদ সীমানা :
বাঙ্গালি জাতির উদ্ভব :
ভূতাত্তিক গঠনের দিক দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড গঠিত হয় প্লাইস্টোসিনযুগে (প্রায় ১০-২৫ লক্ষ বছর পূর্বে। এর পরের যুগকে বলা হয় প্লাইস্টোসিন কাল। প্লাইস্টোসিন কালেই (প্রায় ২৫,০০০ বছর পূর্বে) বাংলাদেশে মানুষের আবিভাব ঘটে। বর্তমান বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী দীর্ঘকালব্যাপী বহু জাতির সমম্বয়ে গড়ে উঠেছে।
সুতরাং বাঙালি জাতির উদ্ভবের ইতিহাসে সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠকে দু’ভাবে ভাগ করা যায়:
ক. প্রাক-আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী
ও
খ. আর্য নরগোষ্ঠী।
আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠী মূলত নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচীনীয় এই চার শাখায় বিভক্ত ছিল। অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ তাদের নিষাদ জাতি হিসেবে আখ্যা দেয়। প্রায় ৫-৬ হাজার বছর পূর্বে অস্ট্রিক জাতি ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে। অষ্ট্রিক জাতির সময়কালে বা কিছু পরে দ্রাবিড় জাতি এ দেশে আসে এবং সভ্যতায় উন্নততর বলে তারা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই সৃষ্টি হয়েছে আর্য-পূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠী। এদের রক্তধারা বর্তমান বাঙালি জাতির মধ্যে প্রবহমান। এভাবে অন্তত দেড় হাজার বছরের অনুশীলন, গ্রহণ, বর্জন ও রূপান্তরীকরণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির উদ্ভব ও বিকাশের ধারাটি বর্তমান জাতিসত্তায় পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই বাঙালি জাতি সংকর জাতি হিসেবে বিবেচিত।