বাঙ্গালী জাতির জীবনে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্ব
ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা।। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালের পাকিস্তানের লাহোরে নেজামে ইসলামী নেতা চৌধুরি মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে বিরোধী দলের একটি সম্মোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঐতিহাসিক যে ছয়টি দাবি উত্থাপন করেন তা ছয় দফা দাবি নামে পরিচিত।
ঐতিহাসিক ছয় দফার পটভূমিঃ ৬ দফা কর্মসূচি ছিল দীর্ঘকাল ধরে বাঙালী জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া শাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের পটভূমিতে গড়ে উঠা জাতীয় মুক্তির অব্যর্থ মূলমন্ত্র। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালীদের ওপর চালিয়ে যা্ওয়া শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে ছয়দফা ছিল সর্বপ্রথম সুসংগঠিত পদক্ষেপ। ছয় দফা কর্মসূচির পটভূমি নিম্নরুপঃ
রাজনৈতিক পটভূমিঃ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভ করেছিল যেখানে বলা হয়েছিল পাকিস্তান হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে।
• ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে ও পাকিস্তান সরকার মিথ্যা দোষ চাপিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করেছিল।পাকিস্তানের তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করেন। যুক্তফ্রন্টের নেতা কর্মীরা তা মেনে নিতে পারে নি। কাজেই পরবর্তীতে ছয় দফা ঘোষণার পেছনে এই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বনখাস্তর যে বিষয়টি সেটি ও একটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে।
• ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি অগণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। যে কারণে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করার সে সময়ে প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
• ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন যে রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেই রিপোর্টে পূর্ব-পাকিস্তানের উচ্চ শিক্ষা লাভের পথ বন্ধ হয়ে যায়। এবং অনৈতিকভাবে ফার্সি ভাষা শিক্ষা গ্রহণকে স্কু পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা হয়। যেই কারণে শিক্ষা গ্রহণে মূল প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় এবং যা ছয় দফা দাবি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বাধ্য হয়।
• ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। সেই পাক-ভারত যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করলে ও পূর্ব পাকিস্তান ছিল একেবারেই অরক্ষিত। এই কারণে ছয় দফার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সরকার গঠনের একটি বিষয় ছয় দফায় স্থান পায়।
প্রশাসনিক পটভূমিঃ ১ম শ্রেণির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রের বৈষম্য দেখা দেয়। সরকারি চাকুরী প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ অগ্রধিকার পেলে ও এক্সেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ চরমভাবে বঞ্চিত।
• আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় ৬২জন মন্ত্রীর মধ্যে বাঙালী মন্ত্রী ছিল ২২ জন। এবং এই ২২ জনের কাউকে কোন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রাণালয়ে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যে কারণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাথ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ২২ জনের মতামত যথেষ্ট ছিল না। যে কারণে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ব পাকিস্তান অথাৎ বাঙালীরা বঞ্চিত হতে থাকে।
অর্থনৈতিক পটভূমিঃ ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলোর সদর দপ্তর অবস্থিত ছিল পাকিস্তানে অথাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে। স্বাভাবিক কারণে সমস্ত রিজার্ভ এবং সমস্ত অর্থ জমা হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানে। এবং পূর্ব-পাকিস্তান কৌশলগত কারণে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চণার শিকার হতে থাকে।
• ১৯৬১ সালের একটি সমীক্ষায় উল্লেখ্য করা হয় যে দু’দেশের অর্থনৈতিক অবদানের ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের অবদান ২২% হলে ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১২%।
• ১৯৬০ সাল পর্যন্ত রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তান ৬০ শতাংশ অবদান রাখলেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্ধ রাখা হয়নি।
• পাকিস্তানের ১ম পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনায় পূর্ব-পাকিস্তানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু ব্যয় ধরা হয় ৮০ টাকা আর অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু ব্যয় ধরা হয় ২০৫ টাকা।
• ২য় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই বৈষম্য কমানোর চেষ্টা করা হয় এবং পূর্ব-পাকিস্তানে এই সময়ে মাথাপিছু উন্নয়ন বরাদ্ধ ধরা হয় ১৯০ টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ২৯২ টাকা। কাজেই অর্থনৈতিক এই বঞ্চণার থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যই ছয় দফা দাবির প্রয়োজন ছিল।
• পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ট্রেজারিতে পশ্চিম পাকিস্তানে তুলনায় প্রায় ২০০ কোটি টাকা পূর্ব-পাকিস্তান বেশি অবদান রাখলে ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাবরই পূর্ব-পাকিস্তান বঞ্চিত হতে থাকে। প্রত্যেক বছর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৪০ কোটি টাকার বিদেশী পণ্য আমদানি করলে ও এই ৪০ কোটি টাকার আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রী পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষকে ভোগ থেকে বঞ্চিত করে। কাজেই ছয় দফা দাবি ঘোষণা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।
সামরিক প্রেক্ষাপটঃ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। কাজেই সামরিক দিক দিয়ে ও পূর্ব-পাকিস্তান ছিল অত্যন্ত নাজুক অবস্থা।সামরিক বাহিনীর নিয়োগের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব-পাকিস্তান বঞ্চিত হতে থাকে। কাজেই এই অঞ্চলের সামরিক নিরপত্তা বা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব-পাকিস্তান হুমকির মুখে থাকে। যা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে।
উপরিক্ত প্রেক্ষাপটের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করতে বাধ্য হয়।
ছয় দফা বাঙালী জাতির মুক্তির সনদঃ ৬ দফা আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লাগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সংগে মিল রেখে। ৬ দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য-পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।
৬ দফার দাবিসমূহ–
দফা-১: পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রকৃতিঃ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র এবং পরবর্তীতে সকল নির্বাচন হবে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে এবং আইনসমগ্র সার্বভৌমত্ব থাকবে। ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক পাকিস্তানের লাহোরে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন সেটাই ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব।
দফা-২: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাঃ দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র এই দুটো বিষয় থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। অন্যান্য বাকি সকল বিষয় থাকবে আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারের হাতে।
দফা-৩: মুদ্রা সংক্রান্ত ক্ষমতাঃ পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্য দুটি আলাদা অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন থাকবে। অথবা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধের উদ্দেশ্যে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মাধ্যমে দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবের্।